স্টাফ রিপোর্টার ঃ প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। কাজেই অভিবাসনকে যেমন নিরাপদ করতে হবে তেমনি বিদেশ-ফেরত মানুষের পাশেও দাঁড়াতে হবে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম সেই কাজগুলো করার চেষ্টা করছে। ময়মনসিংহ বা দেশের যে কোন জেলায় বিদেশ থেকে ফিরে আসা মানুষ ব্র্যাকের প্রত্যাশা-২ প্রকল্প থেকে মনোসামাজিক কাউন্সেলিং, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরেকত্রীকরণে সহায়তা পাবেন। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনসহ সরকারের নানা দপ্তরও তাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
গত সোমবার (২৯ এপ্রিল), ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের উদ্যোগে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী। ব্র্যাকের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন মাইগ্রেশন কর্মসূচির সিনিয়র ম্যানেজার মোঃ সাজ্জাদ হোসেন, ডেপুটি ম্যানেজার ব্লেইজ অ্যান্থনি গোমেজ, ব্র্যাক জেলা সমন্বয়কারী মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, মাইগ্রেশন অ্যান্ড রিইন্ট্রিগ্রেশন সাপোর্ট সেন্টারসহ ময়মনসিংহে কর্মরত ব্র্যাকের বিভিন্ন প্রোগ্রামের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিগণ।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন কর্মসূচির পক্ষ হতে মোঃ সাজ্জাদ হোসেন, প্রত্যাশা-২ প্রকল্প প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঝুঁকিগ্রস্ত বিদেশ-ফেরত বাংলাদেশিদের জেন্ডার সংবেদনশীল উপায়ে টেকসইভাবে পুনরেকত্রীকরণের কাজ চলছে ইমপ্রুভড সাসটেইনেবল রিইন্ট্রিগ্রেশন অব বাংলাদেশি রিটার্নি মাইগ্রেন্টস (প্রত্যাশা-২) প্রকল্পের মাধ্যমে। যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্র্যাকের যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পের প্রথম ধাপেও বিদেশ-ফেরত অভিবাসীদেরকে জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে ব্র্যাক।’
প্রত্যাশা-২ প্রকল্পের অধীনে দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাময়িক আবাসন ও চিকিৎসার পাশাপাশি নানা জরুরি সহায়তা পাবেন ১০,০০০ জন বিদেশ-ফেরত অভিবাসী। পাশাপাশি মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেবা, অর্থনৈতিক পুনরেকত্রীকরণের জন্যও প্রয়োজন অনুসারে সহায়তা পাবেন ঝুঁকিগ্রস্ত বিদেশ-ফেরত অভিবাসীরা।
বিদেশ-ফেরতদের সমাজে ও জীবনে পুনরেকত্রীকরণের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্র্যাকের যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রত্যাশা-২ প্রকল্পের সাফল্য কামনা করে প্রধান অতিথি দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কিংবা প্রতারিত হয়ে যারা ফেরত এসেছেন, তাদের মতো অসহায় মানুষকে নিয়ে ব্র্যাক অত্যন্ত সুন্দর ও মানবিক একটি প্রকল্প ‘প্রত্যাশা-২’ বাস্তবায়ন করছে। প্রতারণা থেকে বাঁচতে প্রশিক্ষিত হয়ে নিয়ম মেনে বিদেশ যাওয়ার উপরে আমাদের গুরুত্বারোপ করতে হবে।’
আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, টিটিসি, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে সরকারিভাবে বিভিন্ন রকম কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিদেশফেরত অভিবাসীরাও প্রশিক্ষিত হয়ে আয়বর্ধণমূলক কাজ করতে পারেন। বিদেশ-ফেরত অভিবাসীদেরকে নিয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রকল্পের ‘প্রত্যাশা-২’ প্রকল্পটিকে সহযোগিতা করার জন্য উপস্থিত সকলকে, বিশেষ করে সরকারি বিভাগের কর্মকর্তাদের আহ্বান জানান তিনি।
সভায় আমন্ত্রিত অতিথি কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ময়মনসিংহের সম্মানিত অধ্যক্ষ প্রকৌঃ মোঃ মাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘অভিবাসীরা যে ভিসা নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদেরকে যাওয়ার পূর্বেই কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত যে তার এই (বিদেশ গমনের) সিদ্ধান্তে ফলে কী হতে পারে। তিনি আরও বলেন, যেকোন দেশে যাওয়ার পূর্বে ওই দেশের ভাষা, আইন এবং যেকোন একটি কাজের বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে গেলে, বিদেশ যেয়ে হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে না। কাজের দক্ষতা নিয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করে বিদেশ গেলে সেখানে ভালো বেতন প্রাপ্তি ও সুষম কাজের পরিবেশ পাওয়ার মাধ্যমে মূল্যায়িত হওয়ার সুযোগ বেশি। সরকারের পাশাপাশি অভিবাসী ও বিদেশ-ফেরত অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামকে তিনি বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং সার্বিকভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
আমন্ত্রিত অতিথি জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, ময়মনসিংহের সহকারী পরিচালক অমিত সরকার বলেন, তিনি যখন ২০২২ সালে ময়মনসিংহ অঞ্চলে আসেন তখন উক্ত অঞ্চলে বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের নিয়ে কোন কার্যক্রম ছিল না, যা ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। বর্তমানে অভিবাসীদেও প্রশিক্ষিত হয়ে বিদেশে যেয়ে কাজ করার জন্য পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত একটি জেলা বলা যায় ময়মনসিংহকে। ডেমো, টিটিসি, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, ওয়েলফেয়ার সেন্টার, ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামসহ সকল প্রতিষ্ঠানই এখানে আছে এবং সকলেরই কাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রায় একই। সকলে মিলে একসাথে কাজ করলে আমরা অভিবাসী ও বিদেশফেরত অভিবাসীদের কাছে সর্বোচ্চ সেবা পৌঁছে দিতে পারবো।
সভায় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, ময়মনসিংহের উপ-পরিচালক মোঃ হারুন-অর-রশীদ বলেন, আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন জায়গায় হয়রানি, হেনস্থার শিকার হন, নির্যাতিত হন। ব্র্যাক যদি তাঁদেরকে দেশে ফেরত আসার পরে সহযোগিতা করে তবে সরকারের কাজ সহজ হয়ে যায়। ময়মনসিংহের মানুষেরা ভাগ্যবান যে এরকম একটি প্রকল্পের কাজ এখানে চলছে। দক্ষতার অভাবেই যেহেতু বেশিরভাগ প্রবাসী দেশে ফেরত আসেন, তাই এই বিদেশ ফেরতদের প্রশিক্ষণ দিতে চায় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। পূর্বে ব্র্যাকের সঙ্গে সমঝোতা ছিল এবং বর্তমানে নারীদের যুক্ত করার মাধ্যমে যে নতুন মাত্রা তাদের কাজে এসেছে তাও অনেক প্রশংসাযোগ্য। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির পার্থক্য যেন কম থাকে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি ব্র্যাক মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রত্যাশা-২ প্রকল্পের মনোসামাজিক সেবা, দক্ষতা উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সেবার মাধ্যমে পুনরেকত্রীকরণের প্রশংসা করেন।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন জেলার অভিবাসন বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ, বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ, সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ, বিদেশ-ফেরত অভিবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যগণ।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সংস্থা এবং সারাবিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এনজিও ব্র্যাক, ১৯৭২ সালের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে দেশে ও দেশের বাইরে নানাবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি কর্মসূচি হল মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম। ব্র্যাকের এই প্রোগ্রাম ২০০৬ সাল থেকে দেশের অভিবাসনপ্রবণ জেলাসমূহে বিদেশগামী নারী ও পুরুষের মাঝে সঠিক তথ্যের মাধ্যমে নিরাপদ অভিবাসন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম, বিদেশ-ফেরতদের পুনরেকত্রীকরণের, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, অভিবাসন খাতে অ্যাডভোকেসি ও নানাবিধ সহযোগিতা মূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে।
আপনার মতামত লিখুন :